মহান মে দিবস

১লা মে কিভাবে শ্রমিক দিবস হলো?

শরিফ উল আনোয়ার সজ্জন


১লা মে কিভাবে শ্রমিক দিবস হলো?

প্রতি বছর ১ মে সারা বিশ্বে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। ১৮৮৬ সালে আমোরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিবসটি পালিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন। আরও অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।

মে দিবসের আন্দোলনের আগে শ্রমিকদের কাজ করতে হতো ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা। বহুদিন ধরে চলে আসা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা মুখর হতে শুরু করেছিল উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে।

১৮৬৪ সাল থেকে এই দাবিতে নানা স্থানে গড়ে উঠতে থাকে ‘আট ঘণ্টার শ্রম সমিতি’। ন্যশনাল লেবার ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে আট ঘণ্টা আইন পাস করার দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছিল। অবশেষে ১৮৬৮ সালে আমেরিকার আইন সভায় ‘আট ঘণ্টার কাজ’-এর একটি আইন পাস হয়।

শ্রমিকরা ভেবেছিলেন, এবার তাদের দাবি বাস্তবায়িত হতে শুরু করবে। কিন্তু সেই সময়কার সরকারব্যবস্থায় আইন পাস করানোটাই যে যথেষ্ট নয়, তার প্রয়োগের দাবিতেও দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি, সেটা বুঝতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর।

অবশেষে ১৮৮৬ সালের ১ মে এই শ্রমিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি হয়। সেদিন দৈনিক আট ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা আমোরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে কয়েক লাখ শ্রমিকের জমায়েত হয়েছিল। সমাবেশের এক পর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। শুরু হয় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ, নিহত হয় ৮ জন শ্রমিক ও ৭ জন পুলিশ।

১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।

এর পরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংগঠনের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

সেই সম্মেলনে শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না খাকলে বিশ্বজুড়ে সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে তারিখে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকরী হয়।

দীর্ঘদিন ধরে কিছু সমাজতান্ত্রিক সংগঠন তাদের দাবি জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসেবে বেছে নেয়। কোনো কোনো স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ এবং ভারতেও এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতে মে দিবসের সূচনা বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ১৯২৩ সালের ১ মে, মাদ্রাজের সমুদ্রসৈকতে শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেলু চেটিয়ারের সভাপতিত্বে ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয়েছিল। সেই সভা থেকেই এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল।

তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় ১৯২৭ সালে প্রথম মে দিবস পালন করা হয়।

দেশ বিভাগের পূর্বে নারায়ণগঞ্জে মে দিবস পালিত হয় ১৯৩৮ সালে।

১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সালের মে মাস পর্যন্ত মে দিবস সীমিত পরিসরে পালিত হয়। ১৯৫৩ সালে পল্টনে মে দিবসের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশের শ্রমিকরা প্রথমবারের মতো বিপুল উৎসাহ নিয়ে মে দিবস পালন করে।

আদমজীতে ৩০ হাজার শ্রমিক লাল পতাকা নিয়ে সভা সমাবেশ মিছিলে অংশ নেয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পূর্ব পর্যন্ত মে দিবস বেশ বড় আকারে সমাবেশের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এই সময় ১ মে দিনটিকে সরকার ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণার দাবি ওঠে।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর শ্রমিকদের বিরাট অংশ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে। ১৯৭০ সালে মে দিবস পালনে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ করা যায়।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবসটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। ১৯৭২ সালে ১ মে কে মহান মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মে দিবস পালিত হয়। তবে যে দেশে ঘটনার জন্ম, তবে যে দেশের শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে এই দিনটি অর্জিত হলো সেই আমেরিকাতে মে দিবস পালিত হয় না।